হাসান যোবায়ের একজন অ্যানিমেটর ও ব্লগার। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি অ্যানিমেশন নিয়ে কাজ করছেন, পেয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ২০১৬ সালে তার তৈরি থ্রিডি কম্পিউটার অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্ম ‘হ্যাপি ওয়ার্ল্ড’ পেয়েছে
‘উই আর্ট ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল ৩’-এর ‘পাবলিক প্রাইজ’ অ্যাওয়ার্ড। এছাড়া ২০১৪ সালে বাংলাদেশের ন্যাশনাল ফিল্ম প্রতিযোগিতায় ‘ফিরে এসো ফারিয়া’ নামক শর্ট ফিল্মটির জন্য তিনি পেয়েছেন ‘বেস্ট ফিল্ম পপুলার চয়েজ অ্যাওয়ার্ড’। নবীনদের জন্য তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বাংলা টিউটোরিয়াল সাইট ‘প্রযুক্তি টিম ডটকম’ তৈরি করেছেন এই অ্যানিমেশন সিনেমা নির্মাতা। অ্যানিমেশনের নানা বিষয় নিয়ে দৈনিক ইনকিলাবের সাথে কথা হয় তার। এ সময় কথোপকথনে ছিলেন নুরুল ইসলাম।
ইনকিলাব: অ্যানিমেশন বলতে আসলে কী বোঝায়?
হাসান যোবায়ের: অ্যানিমেশন হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে অনেকগুলো স্থির চিত্রকে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে ভিডিও আকারে তৈরি করা হয়। অ্যানিমেশন অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন: ট্রাডিশনাল, টু ডি, থ্রি ডি, স্টপ মোশন ইত্যাদি। তবে এখন আমরা সচরাচর যে দুই ধরনের অ্যানিমেশন টিভিতে, সিনেমায় কিংবা ইন্টারনেটে দেখে থাকি, সেগুলো হলো- টু ডি ও থ্রি ডি।
আমরা ছোট বেলায় যে টম এন্ড জেরি, টারজান, মীনাসহ যত রকম কার্টুন দেখেছি, সেগুলোই টু ডি অ্যানিমেশনে তৈরি।
সাধারণত হাতে ড্রয়িং করে এই অ্যানিমেশনগুলো তৈরি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে যে অ্যানিমেশনের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়, সেটা হলো থ্রি ডি কম্পিউটার অ্যানিমেশন। এটি অনেকগুলো সফটওয়্যার দিয়ে বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে তৈরি করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা কুং ফু পান্ডা, ফাইন্ডিং নিমো, টয় স্টোরিসহ হলিউডের যত জনপ্রিয় অ্যানিমেশন সিনেমাগুলো দেখি, সেগুলো প্রায় সবই তৈরি হয় কম্পিউটার থ্রি ডি অ্যানিমেশনে। টু ডি এবং থ্রি ডি অ্যানিমেশন ছাড়াও আরেকটি বিষয় রয়েছে। সেটা হচ্ছে সিজি (কম্পিউটার গ্রাফিক্স) অথবা ভিএসএক্স (ভিজুয়্যাল ইফেক্ট)। এটা থ্রি ডি অ্যানিমেশনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা হলিউডের যত অ্যাকশন, সুপার হিরোয়িক সিনেমা দেখি সেগুলোর ৫০% কাজই হচ্ছে সিজি কিংবা ভিএসএক্স’র মাধ্যমে। আর সিজিতে যত কাজ রয়েছে তার ৭০% কাজই হচ্ছে থ্রি ডি কম্পিউটার অ্যানিমেশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ যে কম্পিউটার অ্যানিমেশনের কাজ পারবে সে ইচ্ছে করলে ভিএফএক্স সেক্টরেরও কাজ করতে পারবে। যদিও দু’টি সেক্টরই অনেক অনেক বড়।
একটি বাস্তবিক দৃশ্যের সাথে কম্পিউটারে তৈরি সেট কিংবা অ্যানিমেশন যুক্ত করার পদ্ধতিই হচ্ছে সিজি বা ভিএসএক্স। ধরুন, সিনেমায় দেখাচ্ছে যে, সুপারম্যান ১০০ তলা উপর থেকে লাফ দিলো এবং উড়তে উড়তে নিচে পড়লো। এখন প্রশ্ন হলো, এই ভিডিওটি কিভাবে তৈরি হলো? সত্যি সত্যি কি সে ১০০ তলা থেকে লাফ দিয়েছে? মোটেও না। বাস্তবে সুপারম্যান চেয়ার বা সামান্য উঁচু জায়গা থেকে লাফ দেয়। আর বাকি যে অংশ রয়েছে যেমন ১০০ তলা বিল্ডিং, আশে পাশের পরিবেশ, সুপারম্যানের আধ্যাত্মিক সুপার পাওয়ার সব কিছুই থ্রি ডি’র মাধ্যমে তৈরি করা হয়। তারপর সেই কম্পিউটার থ্রি ডি এবং বাস্তব সুপারম্যানের ভিডিও ক্লিপ যেভাবে যুক্ত করা হয় সেটাই হচ্ছে ভিএসএক্স’র কারিশমা। নায়কের অভিনয়ের পাশাপাশি শত শত ভিএসএক্স আর্টিস্টের পরিশ্রমের ফসলই হচ্ছে হলিউডের ব্লক ব্লাস্টার সব সিনেমা।
ইনকিলাব: আপনি কখন এবং কীভাবে এই কাজের সাথে যুক্ত হলেন?
হাসান যোবায়ের: আমার শুরুটা হয়েছিল গ্রাফিক্স ডিজাইন দিয়ে। ফটোশপ, ইলাস্টেটর শেখার পর গ্রাফিক্সের কাজ করতাম। পরবর্তীতে মাল্টিমিডিয়া নিয়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা শুরু করার সুবাধে বিভিন্ন সফটওয়্যার সম্পর্কে জানতে লাগলাম। সিনেমার প্রতি আমার সব সময়ই দুর্বলতা ছিল। সিনেমা নির্মাণ যখন শিখতে থাকি, তখন মনে হলো আমার প্রযুক্তি প্রেম এবং সিনেমা দুইটা এক সাথে শুধুমাত্র কম্পিউটার অ্যানিমেশন সিনেমাই পূরণ করতে পারে। সেভাবেই ধীরে ধীরে অ্যানিমেশন জগতে প্রবেশ। এখন প্রতিনিয়ত কাজ করছি, সাথে সাথে নতুন নতুন জিনিস শিখছি।
ইনকিলাব: দেশে বিদেশে অ্যানিমেশনের চাহিদা কেমন?
হাসান যোবায়ের: অ্যানিমেশন আবিষ্কারের পর থেকেই এর চাহিদা সব সময়ই ছিল, এখন আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিদেশে কম্পিউটার অ্যানিমেশনের কেমন চাহিদা তা অ্যানিমেশন সিনেমাগুলোর আয় এবং খরচ দেখলেই ধারণা পাওয়া যায়। আর অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোতেও এর চাহিদা ব্যাপক। আর আমাদের দেশে টিভি ইন্ডাস্ট্রিতে মোশন গ্রাফিক্সের বেশ ভাল চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন চ্যানেলে টাইটেল অ্যানিমেশনের কাজ প্রচুর পরিমাণে হয়ে থাকে। এছাড়া বিজ্ঞাপনেও প্রচুর অ্যানিমেশনের কাজ হয়ে থাকে। কিন্তু অ্যানিমেশন সিনেমা বা ক্যারেক্টার অ্যানিমেশন আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। কারণ ক্যারেক্টার অ্যানিমেশন শিখতে যেমন প্রচুর সময় লাগে তেমনি টিম ছাড়া অ্যানিমেশন সিনেমা করাও বেশ কঠিন। তবে আশা করা যায়, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেশেও ক্যারেক্টার অ্যানিমেশন সিনেমার প্রচলন শুরু হবে।
এছাড়া সরকারও গেম, অ্যানিমেশনের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। বড় বাজেটের কাজ পাওয়া খুবই সোজা যদি দক্ষতা থাকে। আর্কিটেকচারাল ভিজুয়ালাইজেশনের কাজ প্রচুর পরিমাণে আমাদের দেশে হয়ে থাকে। তাই অ্যানিমেশনে দক্ষ হলে কাউকে বেকার বসে থাকতে হবে না। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের কাজ আমাদের দেশেই হচ্ছে। অনেকে বাইরে থেকে কম্পিউটার অ্যানিমেশন নিয়ে পড়াশুনা করে এসে আমাদের দেশে কাজ করছে।
ইনকিলাব: এই সেক্টরে কাজ করার জন্য কী ধরনের প্রাথমিক জ্ঞান প্রয়োজন?
হাসান যোবায়ের: অ্যানিমেশনের জগত অনেক বড়। তাই এই সেক্টরে আসতে হলে বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। আইটি সেক্টরের অন্যান্য কাজের মতো অ্যানিমেশনের জন্যেও কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সম্পর্কিত ভালো ধারণা অবশ্যকীয়। পাশপাশি ড্রয়িং সেন্স, সিনেমা তৈরির কৌশল, সফটওয়্যার চালানোর দক্ষতা, ইংরেজিতে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। গুগল থেকে কিংবা ইউটিউব থেকে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লেখা বা টিউটোরিয়াল খুঁজে বের করা এবং সেগুলো দেখে কাজ শেখার দক্ষতা থাকতে হবে।
ইনকিলাব: ক্যারিয়ার হিসেবে অ্যানিমেশন কেমন?
হাসান যোবায়ের: ক্যারিয়ার হিসেবে অ্যানিমেশন অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোতে গেলেই দেখা যায় কতটা মূল্যায়ন রয়েছে এই কাজগুলোর। অন্যান্য কাজের তুলনায় বিডের সংখ্যাও অনেক কম। আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতেও বেশ ভালো বেতনের জব পাওয়া যায়। এছাড়া বড় বড় কর্পোরেট অফিসগুলোতে অ্যানিমেটরের অনেক চাহিদা রয়েছে। সব মিলিয়ে বলবো, চ্যালেঞ্জ নিয়ে যারা কাজ করতে ভালোবাসেন, তারা এই সেক্টরে গড়তে পারেন এক উজ্জ্বলতম ক্যারিয়ার। যেমনটা বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন তরুণ নিজ যোগ্যতায় অ্যানিমেটর হিসেবে হলিউডে জায়গা করে নিয়েছেন। তবে আমাদের দেশে অনেক অভিভাবকরা এই বিষয়টি সহজভাবে নাও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে এই সেক্টরে আগ্রহীরা যদি অভিভাবকদের সুন্দরভাবে বুঝাতে পারেন যে, এখানেও চমৎকার ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব, তাহলে ওনারা বুঝবেন এবং সব ধরনের সহযোগিতাও করবেন।
ইনকিলাব: এখানে খ-কালীন কাজের সুযোগ কতটুকু?
হাসান যোবায়ের: খ-কালীন কাজের সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। অ্যানিমেশন স্টুডিওতে অনেক রকম স্কিলের টিম মেম্বারের প্রয়োজন হয়ে থাকে। অ্যানিমেশন টিমের কোন মেম্বার হতে হলে ন্যূনতম একটি বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। সেটা হতে পারে মডেলিং, রিগিং, অ্যানিমেশন নির্মাতা, অ্যানিমেশন এডিটর, ভিএফএক্স এক্সপার্ট কিংবা লাইটিং আর্টিস্ট হিসেবে। তবে খ-কালীন কাজ করে আয় করতে হলেও ন্যূনতম ৬ মাসের উপরে এই বিষয় নিয়ে স্টাডি করতে হবে। সেখানে ভালো করতে পারলে হয়তো তার এই খ-কালীন পেশাটাই হতে পারে তার মূল পেশা।
ইনকিলাব: অ্যানিমেশনকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিলে মাসে কত টাকা আয় করা যাবে?
হাসান যোবায়ের: অ্যানিমেশনে আয়ের বিষয়টা নির্ভর করবে যোগ্যতা, পরিশ্রম এবং সঠিক প্লাটফর্মের উপর। যেহেতু দেশে চাহিদা অনুপাতে দক্ষ অ্যানিমেটর কম, সেহেতু এই সেক্টরে দক্ষ হতে পারলে অনেক আয় করা সম্ভব। সেটা হতে পারে মাসে লাখ টাকার উপরে। আর অনলাইন মার্কেট প্লেসে কিংবা বিশ্বের যে কোনো বড় কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করলে দক্ষতা অনুসারে মাসে সর্বনি¤œ হাজার ডলার থেকে শুরু করে দশ হাজার ডলার বা তার চেয়েও বেশি আয় করা সম্ভব। ব্যক্তিভাবে অথবা টিম তৈরি করে কাজ করলেও এখান থেকে ভালো আয় করা খুব বেশি কঠিন নয়। তবে আয়ের কথা চিন্তা করলে এই ধরনের শৈল্পিক কাজে খুব বেশি ভালো করা সম্ভব নয়। মনের ভালো লাগা থেকেই এই কাজগুলো করতে হয়। কাজ যখন ভালো হবে তখন এমনিতেই আয় হবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইনকিলাব: কীভাবে কাজ করলে নবীনরা এখানে সফল হতে পারবে?
হাসান যোবায়ের: নবীনদের জন্য প্রথমে ঠিক করতে হবে, আসলেই মন থেকে সে অ্যানিমেশন শিখতে চায় কিনা? সে জন্য সময় দিতে পারবে কিনা? লক্ষ্য স্থির করার পর তাকে সাধনা শুরু করতে হবে। এই সেক্টরে রাতারাতি ভাল করা সম্ভব নয়। তাই ফাউন্ডেশনটা সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। ভাল করতে হলে বছরের পর বছর সাধনা করতে হয়। এর অর্থ এই নয় যে, সে শুধু বছরের পর বছর ধরে সাধনাই করে যাবে, কিন্তু কোনো উপার্জন করতে পারবে না। মোটামুটি শেখার পর থেকেই উপার্জন আসতে শুরু করবে। তবে পুরোপুরি সফল হওয়াটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো যে, অ্যানিমেশন শেখার কোনো শর্টকাট ওয়ে বা সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। কষ্ট করে পুরোটাই শিখতে হবে। এক্ষেত্রে যেকোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলা, আর্ট কিংবা মাল্টিমিডিয়ার উপরে পড়াশুনা করা হলে তাদের জন্য কিছুটা সহজ হবে।
ইনকিলাব: যারা এই সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী তাদেরকে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
হাসান যোবায়ের: প্রথমেই বলবো এই সেক্টর নিয়ে আগে ঘাঁটাঘাঁটি করুন। যারা এই সেক্টরে কাজ করছেন তাদের সাথে কথা বলুন। গুগলে অনেক অনেক আর্টিকেল পাবেন সেগুলো পড়ুন। আপনার যদি আগে থেকে কম্পিউটার চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে বলবো আগে কম্পিউটারটা ভালোভাবে শিখুন। তারপর বিভিন্ন সফটওয়্যারের কাজ শিখুন, যেমন ফটোশপ, ইলাস্টেটর, মায়া ইত্যাদি। এছাড়া হাতে ছবি আঁকা অনুশীলন করতেও ভুল করবেন না। আপনি যদি আসলেই একান্ত আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে এই বিষয় নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করুন। অনেক কিছু শেখার আছে এই সেক্টরে। সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করে মাঠে নামুন। প্রচ- ইচ্ছা শক্তি ও কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এই কাজই নয়, যেকোনো কাজ করে সফল হওয়া সম্ভব।
মন্তব্য করুন
ফেইসবুক দিয়ে মন্তব্য