একজন ডিজাইনার শুধু একজন শিল্পীই নন বরং একজন জাদুকরও বটে! তাকে শিল্পের জাদুকর বলা যায়। চিত্রশিল্পীরা যেমন রঙতুলির আঁচড়ে বিচিত্র ও অপূর্ব সব শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকেন, ঠিক একইভাবে ডিজাইনাররাও কিছু সফটওয়্যার ও তার মননশীলতা কাজে লাগিয়ে বৈচিত্র্যময় সব ডিজাইন করে থাকেন।
বিভিন্ন লাইন, শেইপ, ইমেজ, টাইপোগ্রাফি, ফন্ট প্রভৃতি মিলেমিশে একটি ডিজাইন পরিপূর্ণতা পায়। তবে এক্ষেত্রে একজন ডিজাইনারকে অবশ্যই ডিজাইনের কিছু মূলনীতি মেনে চলতে হয়। চাইলেই যেমন একজন চিত্রশিল্পী হতে পারে না, তেমনি কেউ শুধু ইচ্ছা করলেই ডিজাইনার হতে পারবে না। এক্ষেত্রে অবশ্যই ডিজাইনের মূল বিষয়গুলো জানার পাশাপাশি সারাবিশ্বের নিত্যনৈমিত্তিক ডিজাইন ট্রেন্ড, ক্লায়েন্টদের চাহিদা, টার্গেট অডিয়েন্সের রুচিবোধ, কোম্পানি বা পণ্যের মূল তথ্য প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে হবে।
আজ আমি ডিজাইনের দশটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করবো।
যেকোনো ডিজাইনের মূল ভিত্তি এই পয়েন্ট, লাইন ও শেইপের উপর নির্ভর করে। আর এগুলোর মাধ্যমেই আপনি আপনার মনের মাধুরী মিশিয়ে ডিজাইন করতে সক্ষম হন। দুইটি পয়েন্ট একত্রিত করলে একটি লাইন তৈরি হয়। আবার এই দুটির সাথে আরেকটি পয়েন্ট যুক্ত করলে একটি ত্রিভুজাকার শেইপ তৈরি হবে। ঠিক একইভাবে অনেকগুলো লাইনের সমন্বয়ে একটি ডিজাইন সম্পূর্ণতা পায়। টু ডাইমেনশনাল বা ত্রি ডাইমেনশনাল আকারের মডেলগুলোও ঠিক একইভাবে একটি প্রাথমিক পর্যায় থেকে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
মানুষ সাধারণত ১০ লক্ষেরও অধিক রঙ বুঝতে পারে। আর প্রত্যেকটা রঙের আলাদা আলাদা অর্থ হয়েছে। ট্রাফিকে যে তিনটি রঙ ব্যবহৃত হয় তা দিয়েই আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারি এই বিষয়টি। লাল বাতি মানে থেমে যাওয়া, সবুজ মানে চলা আর হলুদ অর্থ অপেক্ষা করা। একইভাবে ডিজাইনের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন রঙ বিভিন্ন চিহ্ন প্রকাশে সাহায্য করে। তাই কোনো ডিজাইনে যত্রতত্র রঙ ব্যবহার করা উচিত নয়।
গ্রাফিক ডিজাইনারদেরও বিভিন্ন কালার স্কিম ও প্যালেট থেকে সঠিক কালার বাছাই করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কারণ, অনেক ডিজাইনের কাঠামোর চেয়ে মূল ভুমিকাই রাখে এই রঙ!
ডিজাইনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে টাইপোগ্রাফি। আপনার ডিজাইনের টেক্সটগুলো দেখতে কেমন হবে তা এই টাইপোগ্রাফির উপরেই নির্ভর করে। অনেক টাইপফেস কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে ঠিক করা হয়। বিষয়ের তারতম্যের সাথে সাথে এটিরও পরিবর্তন ঘটে। হাজার হাজার টাইপফেসের ভেতর ডিজাইনের জন্য সঠিকটি বাছাই করতে পারাটা একজন দক্ষ ডিজাইনারের দক্ষতার ভেতর পড়ে।
টাইপোগ্রাফির ক্ষেত্রে স্পেস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেকটা লেটার বা ইলিমেন্ট একে অপরের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত তা বোঝানোর জন্য মাঝেমধ্যে নেগেটিভ স্পেসেরও দরকার রয়েছে। স্পেসকে ডিজাইনের একটি মৌলিক অংশ হিসেবে ধরে নিতে পারলে তা ডিজাইনারদের জন্যই বেশ সুফল বয়ে আনবে। ডিজাইন শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা উচিত।
আপনি যখন কোনো আকর্ষণীয় ডিজাইন করতে চান তখন এই নীতিটি অবশ্যই আপনাকে মেনে চলতে হবে। প্রত্যেকটা ইলিমেন্টসের মধ্যে ব্যালান্স রাখা, ভিজ্যুয়াল ওয়েট অনুযায়ী ডিজাইন পরিবর্তন প্রভৃতি বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। কিছু ডিজাইনের ইলিমেন্টসের মধ্যে আলাদা হালকা একটি গুরুত্ব প্রদান করা উচিত যাতে সেটি ডিজাইনের অন্যান্য বিষয়গুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে।
ক্রম বজায় রাখতে স্কেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি ডিজাইনে সবগুলো বিষয়ই যেমন সমান গুরুত্বপূর্ণ না তেমন ডিজাইনের বিভিন্ন ইলিমেন্টসের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক, কোনো সংবাদপত্রের টাইটেল থেকে শুরু করে বিস্তারিত নিউজগুলোর ফন্টগুলো বেশ ছোট। কিন্তু এক্ষেত্রে স্কেল যে ভূমিকা রেখেছে তা প্রত্যেক পাঠকের কাছে সেই সংবাদটি পাঠযোগ্যতা পেয়েছে।
একটি অদৃশ্য জাদুময়তার মতো গ্রিড ও অ্যালাইনমেন্ট ডিজাইনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এটি কোনো ডিজাইনের কাঠামো প্রদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কোনো সংবাদপত্র বা বই পড়ার ক্ষেত্রে টেক্সটগুলো খুব সাজানো গোছানো এবং একটি নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে পাওয়া যায় এই গ্রিড ও অ্যালাইনমেন্টের জাদুর কারণেই। টেক্সটের সাথে অ্যালাইনমেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যেমনঃ মানুষ সাধারণত কোনো বই বা পোস্টারে বাম দিক থেকে ডানদিকেই পড়ে থাকে, কিন্তু কোনো পোস্টারে উপর থাকে নিচের দিকে টেক্সট থাকলে তা পাঠকের পড়ায় বিড়ম্বনা ঘটায়।
ফটোগ্রাফির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও ভিজ্যুয়াল ডিজাইনের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক, আপনি কোনো ইমেজ বা ইলাস্ট্রেশন নিয়ে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে ফ্রেমিং এর যথাযথ ব্যবহার আপনার ডিজাইনকে অন্যান্য ডিজাইন থেকে আলাদা করে তুলবে। তাই প্রত্যেকটা ডিজাইনে বা ইমেজে মূল অংশ কোনটি সেটা আগে বের করতে হবে। আর এভাবেই ফ্রেমিং এর ব্যবহার করতে হবে।
বিভিন্ন টেক্সচার ও প্যাটার্ন যেকোনো ডিজাইনের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশের মতো। হয়তো এগুলো কোনো ডিজাইনের সম্পূর্ণ অংশ জুড়ে থাকবে না, কিন্তু বেশ ভাল একটা ভূমিকা রাখবে। অনেকে ডিজাইনে টেক্সচারকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও এটা আপনার ডিজাইনে যে ভিন্নমাত্রা দিবে তা সত্যিই আকর্ষণীয়। Bevel, Emboss অথবা UV Varnish এর মতো টেক্সচার প্রদানে যেকোনো ডিজাইন একটি ভিন্নমাত্রা পায়। তাই ভিজ্যুয়াল ডিজাইনের ক্ষেত্রে এই টেক্সচার ও প্যাটার্নের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পেছনেই এই নীতিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকটা ডিজাইনের ভেতরের খবর বলে দেয় এই ভিজ্যুয়াল কনসেপ্ট। এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত যাতে ডিজাইনে থাকা প্রত্যেকটা জিনিস একে অপরের সাথে ভালোভাবে সংযুক্ত হতে পারে। এভাবে আপনি খুব সহজেই আপনার ক্লায়েন্টের রিকুয়ারমেন্ট অনুযায়ী সফলতা অর্জন করতে পারবেন। এছাড়া একটি পরিপূর্ণ ডিজাইন অনেকদিন পর্যন্ত মানুষের মনে জায়গা করে থাকে।
“একটা ভাল ডিজাইন কখনোই ট্রেন্ড ফলো করে না, বরং নতুন একটি ট্রেন্ডের জন্ম দেয়”
আর এভাবেই টাইপোগ্রাফি, লাইন, শেইপ, কালার, টেক্সচার, প্যাটার্ন, গ্রিড, ভিজ্যুয়াল কনসেপ্ট প্রভৃতি নীতিগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার একটি ডিজাইনকে প্রফেশনাল রুপ দিতে সাহায্য করে। প্রত্যেক ডিজাইনারকে অবশ্যই এই নীতিগুলো মেনে চলা উচিত।
তথ্যসূত্রঃ
https://blog.prototypr.io
মন্তব্য করুন
ফেইসবুক দিয়ে মন্তব্য