শৈশবে অনেকেরই স্বপ্ন থাকে স্থপতি হওয়ার। খেলার ব্লক দিয়ে ছোট ছোট বাড়ি তৈরি করতে করতেই আস্তে আস্তে বুনতে থাকেন স্থপতি হওয়ার স্বপ্নের জাল।এভাবে, ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য কৌশলে ভর্তি হয়ে অনেকে এগিয়ে যান স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে। ৫ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, সাধনা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আস্তে আস্তে অর্জন করে ফেলেন স্থাপত্যের বহু আকাংখিত ব্যাচেলর ইন আর্কিটেকচার ডিগ্রি। এর ফলশ্রুতিতেই শুরু হয়, স্থপতি হিসেবে তার পদচারণা। দেশের প্রায় সব স্থপতিদের জন্য একটি অপরিহার্য ডিজাইনিং সফটওয়্যার হল AutoCAD। স্নাতক পর্যায়েই এই সফটওয়্যারের সাথে আর্কিটেক্টদের পরিচয় ঘটে। তবে স্থপতির চাকুরি বা স্থাপত্য ব্যবসায় পদার্পনের পর অটোক্যাড ডিজাইনের সাথে সখ্যতা আরো ব্যাপক হয়ে ওঠে।
স্থপতিরা তাদের স্নাতক পর্যায়েই বিভিন্ন ধরণের ডিজাইনিং এর কাজ করেন ক্লাস এসাইনমেন্ট ও প্রজেক্ট ওয়ার্ক হিসেবে। সাধারণতঃ প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে তারা বিভিন্ন ধরণের ম্যানুয়্যাল ডিজাইন করে থাকেন বিভিন্ন ধরণের ম্যাটেরিয়াল দিয়ে। এই ম্যাটেরিয়ালগুলি হতে পারে ককশিট, শোলা, বেত, বাঁশ প্রভৃতি। এই সময় তারা আস্তে আস্তে বিভিন্ন সফটওয়্যারের সাথে পরিচিত হতে থাকেন। কারণ, তারা ম্যানুয়েল ডিজাইনের মাধ্যমে তাদের মানসপটে বিভিন্ন ধরণের ডিজাইনিং এর ব্যপারে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করেন। কিন্তু এখন হল তথ্য প্রযুক্তির যুগ। এযুগে শুধুমাত্র ম্যানুয়্যাল ডিজাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, ডিজাইনের আইডিয়াগুলি ক্লায়েন্টদের সামনে প্রধাণতঃ সফটওয়্যারের মাধ্যমেই তুলে ধরতে হয়। তাই স্থাপত্যের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে সেই অনুযায়ী গড়ে তোলার জন্য তাদের সামর্থের সবটুকু প্রয়োগ করে চেষ্টা করেন বিভিন্ন সফটওয়্যারেও তাদেরকে কৌশলী করে গড়ে তুলতে। এজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন থিওরি কোর্সের পাশাপাশি সফটওয়্যার ডিজাইনিং এও সমান গুরুত্ব প্রদান করেন। দেশের প্রায় সব স্থাপত্যের বিদ্যাপীঠগুলিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিজাইনিং সফটওয়্যার হল অটোক্যাড। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই শুরু হয়ে যায় AutoCAD সফটওয়্যার সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার ল্যাবরেটরি ক্লাসগুলো। এর মাধ্যমেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রথম পরিচিত হন অটোক্যাডের সাথে। অটোক্যাডের ক্লাস করতে করতেই অনেকে এই সফটওয়্যারের প্রেমে পড়ে যান। এর স্ট্যাটাস বার, কুইক এক্সেস টুলবার, বিভিন্ন ট্যাব, রিবন যেন হয়ে ওঠে ছোটবেলায় তার খেলার সাথী ব্লকগুলোর মতোই আপন।
অনেকে এসময় বিভিন্ন আর্কিটেকচার ফার্মে ইন্টার্নশিপে জয়েন করেন যেখানে অটোক্যাডে পারদর্শিতা তাদেরকে এনে দেয় অগ্রাধিকার। অনেকে আবার Freelancing এ জড়িয়ে পড়েন আপওয়ার্ক সহ বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। এর আর্কিটেকচার ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন কাজে অনেক ক্লায়েন্টের প্রাধান্য থাকে অটোক্যাডে পারদর্শি ফ্রিল্যান্সারদের জন্য। তাই অটোক্যাডে পারদর্শি হয়ে আপওয়ার্কে জব এর জন্য বিড করলে সহজেই তারা পেয়ে যান ক্লায়েন্টের ইতিবাচক সাড়া। ফ্রিল্যান্সিং এ কাজ করার মাধ্যমে তার মনের অজান্তেই তৈরি হয় একটি অসাধারণ পোর্টফোলিও যা পরবর্তীতে তাকে বিভিন্ন কাজ পেতে ও উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমানের ক্ষেত্রেও সাহায্য করে থাকে।
অনেকেই আবার অংশ নেন বিভিন্ন ডিজাইনিং প্রতি্যোগিতায়। এসব ডিজাইনিং প্রতিযোগিতায় ডিজাইন জমাদানের একটি নির্দিষ্ট ডেটলাইন থাকে। সেই ডেট লাইনকে সামনে রেখে প্রতিযোগী তার খসড়া ডিজাইন করা শুরু করেন অটোক্যাডে। ধীরে ধীরে মেধা-মননের মিশেলে তার খসড়া নকশাই একসময় রূপ লাভ করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার উপযোগী চূড়ান্ত নকশায়।এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনকারী শিক্ষার্থীদের অটোক্যাডের পারদর্শিতা অর্জনে মেন্টর হিসেবে তাদেরকে অনেক সময় সাহায্য করে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সহৃদয়বান শিক্ষক, আবার অনেকে স্বরণাপন্ন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ সিনিয়র শিক্ষার্থীদের যারা ইতিপূর্বে এরকম বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তাদের সহায়তায় শিক্ষানবিশ ডিজাইনাররা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে হয়ে ওঠেন এক একটি তারকা।এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্য্যক্তিদের সাথেও তৈরি হয় নেটওয়ার্ক যা পরবর্তীতে তাকে বিভিন্ন সময়ে ক্যারিয়ার গড়ে তোলায় সাহায্য করে থাকে।
এগুলো তো গেল শিক্ষাজীবনে ক্যারিয়ার গঠনে অটোক্যাডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের কথা। এছাড়াও স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা তাদের ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন কালচারাল ফ্যাস্টিভাল, পহেলা বৈশাখসহ দেশীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলী নির্মাণ করে থাকেন। এখন আপনি হয়ত চিন্তা করছেন, এখানে তো আপনি প্রধানতঃ ম্যানুয়েল বিভিন্ন বড় বড় কর্মশৈলি দেখতে পান। অটোক্যাডের ভূমিকা তো এখানে নেই নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনি একটু ভুল ভাবছেন। হবু স্থপতিরা যে চূড়ান্ত ম্যানুয়েল স্থাপনাটি তৈরি করবেন তার খসড়া ডিজাইনটি তো করতে হবে কম্পিউটারেই। একবার তিনি যদি তার খসড়া ডিজাইনটি অটোক্যাডে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন,তবেই না তিনি প্রদর্শনীর জন্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী ম্যানুয়েলি নির্মাণে সক্ষম হবেন।
যখন একজন স্থপতি স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশুনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন তখন অটোক্যাডের সাথে তার সম্পর্ক হয়ে ওঠে আরো ঘনীভূত। বিভিন্ন সাইট ভিজিট শেষে ক্লায়েন্টের প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি বিভিন্ন খসড়া নকশা তৈরি করেন। তার এই খসড়া নকশা তৈরি করতে সবচেয়ে প্রথমে তিনি ব্যবহার করেন অটোক্যাড। ধীরে ধীরে খসড়া নকশায় তার মেধা ও মননের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে থাকেন। প্রতিদিন তার কাজ শেষ করে তিনি তার নকশাটি সেইভ করে রাখেন। পরের দিন ঠিক সেখান থেকেই কাজ শুরু করেন। এভাবে কাজের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্লায়েন্টকে তার নকশাটি দেখান ও সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সেই নকশায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনেন। এক্ষাত্রে যেহেতু অটোক্যাডের সেভড ফাইলটি মেইল করা যায় তাই ম্যানুয়েল ডিজাইনের মত এখানে ক্লায়েন্টের সাথে বার বার দেখা করার কোন ঝামেলা থাকে না। এভাবেই এক সময় তৈরি হয়ে যায় তার চূড়ান্ত নকশা। ক্লায়েন্ট অনুমোদন করে দেয়া মাত্রই তার ডিজাইনটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে হস্তান্তর করা হয়ে থাকে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পরে কংক্রিট-ইট-কাঠ-টিন-পারটেক্স বোর্ডের মিশেলে আর্কিটেক্টের স্বপ্নের সেই ডিজাইনকেই বাস্তব রূপ দান করেন।
এছাড়াও অনেক স্থপতি ধীরে ধীরে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায় সফল হন। তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিফল্ট কিছু মডেল তৈরি করে রাখেন যার মাধ্যমে ক্লায়েন্টের কাছে তার কাজগুলি তিনি প্রদর্শন করতে পারেন। এসব মডেল তৈরিতেও তাকে সাহায্য করে অটোক্যাড।
পরিশেষে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, একজন আর্কিটেক্টের বর্ণিল ডিজাইনিং এর জীবনকে আরো বর্ণিল করে তোলার জন্য অটোক্যাডের কোন জুড়ি নেই। অটোক্যাডকে একজন সফল আর্কিটেক্টের থার্ড হ্যান্ড বললেও কিন্তু ভুল বলা হবে না।
মন্তব্য করুন
ফেইসবুক দিয়ে মন্তব্য