বর্তমান বিশ্বে ফ্রিল্যান্সিং একটি অত্যন্ত যুগোপযোগী পেশা হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারাবিশ্বের অনেক নামকরা ফ্রিল্যান্সার তাদের দক্ষতা, পেশাদারিত্ত্ব ও অধ্যবসায় কাজে লাগিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও এই পেশাটি দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ফ্রিল্যান্সিং এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এই পেশায় গৎবাঁধা চাকুরীর মতো একটি নির্দিষ্ট সময় নিজেকে বেঁধে রাখতে হয় না। এখানে নেই কোনো ম্যানেজারের চোখ রাঙানির ভয়ও! নিজের ইচ্ছামতো কাজ করে ঘুরে বেড়ানোর মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া সম্ভব এই পেশায়।
সব ভালোর সাথেই খারাপ কিছু বিষয় চলে আসে। তাই এই পেশায় কিছু ঝুঁকিও থেকে যায়। সময়, ক্লায়েন্টের চাহিদা, অর্থ প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান না করলে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। যা একজন ফ্রিল্যান্সারকে বয়ে চলতে হতে পারে অনেকটা দিন! এছাড়া অন্যান্য আনুসাঙ্গিক কিছু বিষয় আছে যা একজন ফ্রিল্যান্সারকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে। তার ক্যারিয়ারের স্বার্থে, যুগের সাথে অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে।
আজ আমি ফ্রিল্যান্সারদের যে ৬টি বিষয় অবশ্যই মনে চলা উচিত সে ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
গৃহস্থালির যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য একটা আলাদা বাজেট করা উচিত। অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে অযথা টাকা নষ্ট করা উচিত না। কারণ, পেমেন্টের টাকাও একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর আসে। তাই যেকোনো খরচ করার আগে চিন্তাভাবনা করা উচিত। ধরা যাক, আপনি যদি কোনো ক্লায়েন্টের টাকা হাতে পাওয়ার পর ছুটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু দেখা গেলো, সময়মতো টাকা হাতে না আসলো না এবং পরিকল্পনা বাতিল করতে হলো। এক্ষেত্রে যদি আপনি পূর্বের অযাচিত খরচ থেকে সতর্ক থাকতেন তাহলে আর এই সমস্যাটি হতো না। ঠিকমতো বাজেট পরিচালনা করতে পারলে প্রতিমাসে অর্থ সঞ্চয়ের সময় কোনো বাড়তি চাপ পড়ে না এবং আপনার অযাচিত কাজে ব্যয় হওয়া অর্থ ভালো ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন আপনি!
এজন্য প্রতি তিনমাসের জন্য একটা সাম্ভাব্য খরচের তালিকা করা যেতে পারে। বাসাভাড়ার মতো অতি প্রয়োজনীয় খরচগুলো খুব সহজেই নির্ধারণ করা যাবে। এতে করে গড় আয়ের একটা আগাম তথ্য পাওয়া যাবে। আর এরপরই সকল বাজেট তৈরি করা উচিত। প্রতিদিনের খরচের মতো একটা দীর্ঘসময়ের জন্য ও একটা স্বল্পসময়ের জন্য আলাদা আলাদা সঞ্চয় করার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে দূরে থাকা যাবে।
স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে খরচ করা বিষয়গুলো খুঁজে বের করুন। আরাম আয়েশের কথা চিন্তা না করে যদি প্রতিমাসের আয়ের উপর ব্যয়ের হিসাব করা যায় তবে তো কথাই নেই। এতে আপনি নিজেই নিজের সাশ্রয়ী হয়ে খরচ করার অভ্যাস দেখে অবাক হবেন! যেহেতু আপনি ফ্রিল্যান্সার সেহেতু আপনার বাইরে লাঞ্চ করার অভ্যাস, সকালে কিংবা বিকালে চা-কফি খাওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী অতিরিক্ত খরচ হিসেব করে সেগুলোকে খুব সহজেই এড়িয়ে চলা উচিত।
ফ্রিল্যান্সারদের বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে হয়। এজন্য তাকে প্রায় প্রত্যেকবেলায় ট্যাক্স দিতে হয়। এগুলোর মধ্যে বিজ্ঞাপন, ভ্রমণ, আসবাবপত্র, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ইনস্যুরেন্স প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই বিষয়গুলোর জন্য অনেকক্ষেত্রে নিজের প্রয়োজনের খাতিরেও খরচ করতে হয়। কিন্তু নিজগৃহে অফিস পরিচালনার মাধ্যমে ইনস্যুরেন্স, মাসিক খরচ, ভাড়া প্রভৃতি বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা সম্ভব হয়ে উঠে। এছাড়া কোনোকিছু ক্রয় করার পূর্বে একবার ভেবে নেয়া উচিত যে জিনিসটি ক্রয় করছেন সেটি সেই মুহূর্তে আসলেই খুব প্রয়োজনীয় কিনা! যদি পরে ক্রয় করলেও কোনো সমস্যা না হয় তবে তাই করা উচিত।
বার্ষিক আয়কর রিটার্ন প্রত্যেকটা প্রতিটা ফ্রিল্যান্সারেরই একটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনেকেই শেষ মুহূর্তে বা পরে এই ব্যাপারটি মিটিয়ে থাকেন। কিন্তু সেসময় তাদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয়। কারণ ডেডলাইনের পূর্বে এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে না পারলে আপনাকে অবশ্যই জরিমানার টাকা গুনতে হবে। তাই প্রত্যেক মাসে এই আয়কর রিটার্নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জমিয়ে রাখা উচিত। এতে করে আপনি শেষমুহূর্তের অনেক আগেই এই আয়কর পরিশোধ করতে সক্ষম হবেন।
নিশ্চয়তার জন্য একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করে ফেলুন। এতে করে আপনার সাম্ভাব্য খরচগুলোর একটা আগাম সংকেত পেয়ে যাবেন আপনি। পারিবারিক খরচ, বিবাহিতদের জন্য সাংসারিক ও সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ প্রভৃতির জন্য আপনাকে আলাদা টাকা সঞ্চয় করে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সহজ বুদ্ধি হলো আয়ের শতকরা ৫০ ভাগ অতি প্রয়োজনীয় খাতে খরচ করা, ৩০ ভাগ আনুসাঙ্গিক অন্যান্য খাতে খরচ করা ও ২০ ভাগ ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের জন্য জমা রাখা। আসলে এই অভ্যাসটি হয়তো রাতারাতি রপ্ত করা সম্ভব হবে না। কিন্তু ধীর স্থির থেকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের একটা লক্ষ্য পূর্ণ করার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। আর এভাবে যদি আয়ের উপর ব্যয় ও সঞ্চয়ের হিসাব করা যায় তবে আপনার জীবন হয়ে উঠবে স্বাচ্ছন্দ্যময়।
আপনি কতটা যত্নবান হয়ে সঞ্চয় করছেন সেটাকে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি কতটা আয় করছেন সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। আর তবেই উপরের পয়েন্টে বর্ণিত ৫০-৩০-২০ এর স্ট্র্যাটেজি সার্থক হয়ে উঠবে। অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারদের কাজের পরিধি, মার্কেটপ্লেসের নিয়মিত আপডেট, কোনো নির্দিষ্ট কাজে আয়ের রেঞ্জ প্রভৃতি বিষয়গুলোর সাথে নিজের বিষয়গুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ আছে কিনা সে ব্যাপারটিতে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে সেলফ প্রোমোশন, মার্কেটিং প্রভৃতি বিষয়গুলোর উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। সবসময়ই নিজের দক্ষতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কাজেই কোনো কাজের ক্ষেত্রে সেটার বর্তমান মার্কেটপ্লেসে রেট কেমন সেই বিষয়গুলো জেনে নিতে হবে। তারপর নিজের দক্ষতা অনুযায়ী আয়ের রেঞ্জ নির্ধারণ করে নিতে হবে। আর এভাবেই একসময় নিজের সফলতা নিজ হাতেই পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ফ্রিল্যান্সারদের জীবন আচরণ, আয়-ব্যয়ের হিসাব, মার্কেটপ্লেসের পরিস্থিতি, ক্লায়েন্টদের চাহিদা প্রভৃতি বিষয়ে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তাই সকল ফ্রিল্যান্সারকে সফল হতে হলে এসব বিষয় মেনে চলতেই হবে।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.creativebloq.com
মন্তব্য করুন
ফেইসবুক দিয়ে মন্তব্য