বর্তমান বিশ্বে গ্রাফিক ডিজাইন একটি অন্যতম এবং জনপ্রিয় পেশার নাম। দেশবিদেশের প্রচুর গ্রাফিক ডিজাইনার তাদের দক্ষতা ও মেধা কাজে লাগিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের দেশেও এই সেক্টরটিতে প্রচুর ডিজাইনার কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প কিছু নেই। এদিক থেকে বর্তমান সময়ে “গ্রাফিক ডিজাইন” সেক্টরটি সারাবিশ্বের অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোর পাশাপাশি জব সেক্টরেও বিশাল ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন আইটি ফার্ম ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে ফুলটাইম জব থেকে শুরু করে ফ্রিল্যান্সাররা তাদের মেধা ও মননশীলতা কাজে লাগিয়ে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন করছেন। সম্মান বয়ে আনছেন দেশের জন্য।
একজন ডিজাইনার হিসেবে অবশ্যই অন্যান্য দেশের ডিজাইনারদের ডিজাইন ও তাদের কাজ করার ধরণ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা উচিত। আজ আমি Logo Design করে যে সকল আর্টিস্টরা অনেক বেশি আয় করেছেন বা করে গেছেন তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিবো।
Chip Kidd চমৎকার বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত। নিউইয়র্ক সিটির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, Chip Kidd এর জনপ্রিয়তা অন্যান্য সকল ডিজাইনারের তুলনায় তুঙ্গে অবস্থান করছে। তিনি বিখ্যাত লেখক James Elroy, Michael Crichton and Neil Gaiman প্রমুখের বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছেন। আমেরিকার জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন মুভি “জুরাসিক পার্ক” এর বইয়ের প্রচ্ছদও ডিজাইন করেছেন এই বিখ্যাত ডিজাইনার। পরবর্তীকালে জুরাসিক পার্কের বই থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রের পোস্টারের লোগোটি সারাবিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। নব্বই এর দশকে তার করা জুরাসিক পার্কের টি-রেক্স লোগোটি এখনো সবার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
টেক জায়ান্ট স্টিভ জবস আজ আর নেই। কিন্তু তার সৃষ্টি “Apple” এখন সবার কাছে প্রযুক্তির এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমরা কেউই কি জানি “Apple” এর সেই জনপ্রিয় আধখাওয়া আপেলের ডিজাইনটি কে করেছেন? হ্যাঁ, জনপ্রিয় এই লোগোর ডিজাইনের স্রষ্টা Rob Janoff। সারাবিশ্বের ডিজাইনারদের কাছে “Apple” এর তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া এই লোগোটি ডিজাইনের এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। তিনি এই লোগো ডিজাইনের ব্যাখা হিসেবে বলেন, “আমি একবার এক ব্যাগ আপেল কিনেছিলাম। এরপর সেই আপেলগুলোকে একটা বাটিতে রেখে সেগুলো আঁকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো কারণে ভালো একটা ডিজাইন দাঁড় করাতে পারছিলাম না। অবশেষে পরীক্ষার অংশ হিসেবে বাটি থেকে একটা আপেল তুলে নিয়ে সেটায় একটা কামড় বসাই! পরক্ষণে অবিশ্বাস্যকরভাবে ভেবে দেখলাম, কামড় (bite) ও বাইট (byte) এর মতই শোনাচ্ছে। পরে ঐ সামান্য খাওয়া আপেলের ডিজাইন অনুসারে “Apple” এর লোগোর ডিজাইন করি।”
Peter Saville সাধারণত ফ্যাক্টরি রেকর্ডস সঙ্গীত শিল্পীদের এ্যালবামের কাভার ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত। তিনি Unknown Pleasures, Transmission, Blue Monday প্রভৃতি বিখ্যাত এ্যালবামের কাভার ডিজাইন করেছেন। এছাড়াও তিনি Jil Sander এবং Stella McCartney এর মতো বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনারদের সাথে কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান ফ্যাশন হাউজ “Calvin Klein” এর লোগো ডিজাইন করেন।
একশো এর অধিক ডিজাইন এ্যাওয়ার্ড পাওয়া এই বিখ্যাত ডিজাইনার দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ডিজাইন কন্সালটেন্সি প্রতিষ্ঠান “Pentagram” এর সাথে জড়িত আছেন। “Pentagram” এ যোগদানের আগে তিনি দশ বছর গ্রাফিক, ইন্টেরিয়র ও ফার্নিচার ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত স্টুডিও “Vignelli Associates” এর হয়ে কাজ করেছেন। “Pentagram” এ বিভিন্ন প্রজেক্টের মধ্যে তার করা বিখ্যাত ডিজাইনগুলোর মধ্যে New York Jets, Walt Disney ও বিভিন্ন বিলবোর্ড ম্যাগাজিন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি বিখ্যাত গ্রাফিক ডিজাইনের স্কুল “Yale School of Art” এর একজন বড়মাপের পর্যবেক্ষক।
Paul Rand একজন বিখ্যাত আর্ট ডিরেক্টর ও গ্রাফিক ডিজাইনার। তিনি তার ডিজাইন করা বিভিন্ন কর্পোরেট লোগোর জন্য বিখ্যাত। তিনি IBM, UPS, Enron, Morningstar, Inc., Westinghouse, ABC, NeXT প্রভৃতি বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির লোগো ডিজাইন করেছেন।
Jonathan Barnbrook তার ব্যতিক্রমধর্মী ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত। তার ডিজাইন করা VirusFonts টাইপফেসটি ডিজাইনার ও সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও David Bowie এর এ্যালবামের কাভার ডিজাইন করে তিনি সমাদৃত হয়েছেন।
Kate Moross বিখ্যাত স্টুডিও প্রতিষ্ঠান “Studio Moross” এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মূলত একজন আর্ট ডিরেক্টর এবং ডিজাইনার। ২০০৮ সালের দিকে তিনি তার স্বকীয় ট্রেডমার্ক, টাইপোগ্রাফি, ফ্লুয়িড ড্রয়িং স্টাইলের জন্য সবার নজরে আসেন। তিনি যুক্তরাজ্যের একজন অন্যতম সফল ডিজাইনার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এ্যালবাম কাভার থেকে শুরু করে ব্র্যান্ডিং ভিডিও, ম্যাগাজিন কাভার , লাইভ ভিজ্যুয়াল প্রভৃতির মধ্যে নিজের শতভাগ দক্ষতা প্রকাশ করেছেন এই গুণী শিল্পী।
খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি “Nike” এর লোগোর মতো খুব কম লোগো তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। খুব সাধারণভাবে ডিজাইন করা এই লোগোটি সারাবিশ্বে বেশ সমাদৃত হয়েছে এর ডিজাইন ও সাধারণত্বের জন্য। হ্যাঁ, বিখ্যাত এই লোগোর ডিজাইনার Carolyn Davidson। ১৯৭১ সালে Portland State University তে পড়াকালীন সময়ে সেই অল্প বয়সেই এই বিখ্যাত ডিজাইনটি করেছিলেন তিনি। এই ডিজাইনের জন্য তিনি “Nike” এর প্রতিষ্ঠাতার কাছ থেকে মাত্র ৩৫ ডলার উপার্জন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তার অসাধারণ ও অভিনব ডিজাইনের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন করেছিলেন। “Nike” এর এই লোগোটি সাধারণত তার পজিটিভিটির জন্য বিখ্যাত। প্রকৃতপক্ষে এটি গ্রিক দেবতার পাখনার অংশবিশেষের আদলে ডিজাইন করা হয়েছে যা বিজয়কে নির্দেশ করে।
ম্যাগাজিন ডিজাইনের এক অন্যতম প্রবক্তা George Lois। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত US Esquire magazine এ কিছু বিখ্যাত ও বিতর্কিত প্রচ্ছদ ডিজাইনের কাজ করেছেন। ১৯৬৮ সালে এই প্রচ্ছদটিতে তিনি বিখ্যাত বক্সার মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ করেছিলেন। খুব সাধারণভাবে অসাধারণ কিছু ফুটিয়ে তোলার দক্ষতাসম্পন্ন এই ডিজাইনার MTV, VH1, ESPN এবং Tommy Hilfiger এর মতো নামকরা মিডিয়া ও ফ্যাশন হাউজের ডিজাইনের কাজ করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “মানুষ যাতে প্রথম দৃষ্টিতেই কোনো লোগো বা ডিজাইন দেখে বিস্মিত হয় আমি সেভাবেই একটা কাজকে পূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা করি। এছাড়াও আমি কোনো নির্দিষ্ট ডিজাইনে ডিজাইনের অর্থ ও মৌলিকত্ব বিচার করার জন্য অডিয়েন্সকে বাধ্য করি। এতে করে অডিয়েন্স ডিজাইনের ভেতরে থাকা প্রকৃত সৌন্দর্য ও অর্থ খুঁজে পেতে সক্ষম হন”।
বিংশ শতাব্দীতে Saul Bass ডিজাইনারদের সার্কেলে একটি অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় নাম। পোস্টার ডিজাইন থেকে শুরু করে ফিল্মের টাইটেল, লোগো ডিজাইন প্রভৃতি সেক্টরে তার অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। AT&T, Kleenex, United Airlines, Minolta প্রভৃতি নামকরা প্রতিষ্ঠানের লোগো ডিজাইনের কাজটিও এই নিপুণ কারিগরের করা। মৃত্যুর পূর্বে তার করা বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে Martin Scorcese on Goodfellas and Casino উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত ম্যাগাজিন “Telegraph” তাকে নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন করেছে।
যারা গ্রাফিক ডিজাইন সেক্টরে নতুন তারা উপরের এসব মহান ও বিখ্যাত শিল্পীদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে দিতে পারেন!
তথ্যসূত্রঃ
https://www.creativebloq.com
https://www.google.com/
মন্তব্য করুন
ফেইসবুক দিয়ে মন্তব্য