মনে করুন আপনি একজন ডিজাইনার কিংবা সৃজনশীল যেকোনো কাজের সাথে যুক্ত। একসময় অনেক ভালো ভালো ডিজাইন আপনার হাত ধরে এসেছে। কিন্তু সময়ের পটপরিবর্তনে হঠাৎ খেয়াল করলেন আপনি আর আগের মতো সৃজনশীল কাজের জন্ম দিতে পারছেন না। খানিকটা একঘেয়েমি কিংবা মানসিক বিপর্যস্ততা আপনার ক্যারিয়ারের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে! আপনার অডিয়েন্স এবং ক্লায়েন্টরাও হয়তো আগের মতো আর আপনার কাজে মুগ্ধ হতে পারছে না। ডেডলাইন চলে আসলেও আগের মতো আর চমৎকার কাজ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। তখন আপনার আসলে কি করা উচিত?
এই মুহূর্তটাকে অনেকে গালভরা ভাষায় “ক্রিয়েটিভ ব্লক” বলে থাকেন। অনেকে এই ছন্দপতনের সময়টাতে সবার সাথে ফোন, ইমেইল কিংবা সবধরনের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে একাকী থাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু আদতে কি এই সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই অভ্যাসগুলো আপনাকে খুব একটা সাহায্য করবে না! তবে কিছু ট্রিকস অবলম্বন করার মাধ্যমে আপনি হয়তো আপনার সেই আগের ছন্দ ফিরে পেতে পারেন। আর সেই ট্রিকসগুলো নিয়ে আজকে আমাদের এই আয়োজন!
আধুনিকতার এই যুগে আমরা সবাই এখন শহরমুখী হচ্ছি। আর যে কারণে সবুজের সংস্পর্শে আমরা খুব কমই যেতে পারি। সময়ের অভাবে হয়তো আপনি সাগরতীর, লেক কিংবা পাহাড়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু ইচ্ছা করলেই খানিকটা বিশুদ্ধ বাতাস কিংবা প্রকৃতির সংস্পর্শ পেতে বিভিন্ন পার্ক বা উদ্যানে ঘুরে আসতে পারবেন। এই মুক্ত প্রকৃতি আপনার সৃজনশীল মনকে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিবে। সবুজ প্রকৃতির সাথে মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের বেশ ভালো একটি সম্পর্ক রয়েছে। শহরজীবনের বিভিন্ন ঝক্কি-ঝামেলার কারণে আপনার মনমানসিকতার উপর যে বিরুপ প্রভাব পড়েছে তার থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়া যাবে এতে করে। আর এই ফাঁকে টেক্সট মেসেজিং, স্মার্ট ফোন – এই বস্তুগুলোকে টা টা দিন!
একটু খোলা চোখে তাকালেই দেখতে পাবেন স্মার্টফোন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের কতটা অসামাজিক জীবে পরিণত করেছে! পাশাপাশি আমরা হারাচ্ছি আমাদের সৃজনশীলতাকেও! আগে আমাদের কেউ যদি জিজ্ঞাসা করতো, “অবসর সময় কি করো?” তখন এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আমরা হয়তো বলতাম বই পড়ার কথা কিংবা কয়েন ও ডাকটিকিট জমানোর মতো অপূর্ব কিছু অভ্যাসের কথা! কিন্তু এখন আমরা ঠিক সেই একই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে দেই চ্যাট এবং ফেসবুকিং এর কথা! অনেকে হয়তো বলবেন অবসর পেলে তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মেইল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী চেক করার কথা! কিন্তু এটা কিন্তু তার সৃজনশীল কিছু নিয়ে চিন্তা করা থেকে বিরত রাখছে। যা হয়তো তাকে তার সৃজনশীল কাজের জন্য অনেকখানি এগিয়ে রাখতো! আসলে আমাদের মস্তিস্ক একনাগাড়ে অনেককিছুর চাপ নিতে পারে না। তারও কিন্তু বিশ্রামের দরকার পড়ে! আর এই বিশ্রামের সময় যদি সৃজনশীল কিছু নিয়ে চিন্তা করা যায় তবে তা ক্যারিয়ারের জন্য বেশ ভালো একটি প্লাস পয়েন্ট। তাই কিছু সময়ের জন্য ইন্টারনেট থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখটাও জরুরি! এটি সৃজনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
বসে, দাঁড়িয়ে কিংবা সাইকেল চালাতে চালাতেই যেকোনো অসাধারণ ডিজাইন করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুয়ে থেকে অনেক ভালো ভালো ডিজাইনের চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। তাছাড়াও শুয়ে থেকে অনেক কঠিন সমস্যার সমাধানও চলে আসে। তাই এই মুহূর্তে আপনি হয়তো সৃজনশীলতা আনার জন্য বিছানায় শুয়ে পড়তে উদ্যত হচ্ছেন! তবে একটু অপেক্ষা করুন। আরেকটা কাজ বাকি আছে। নতুন কোনো চিন্তাভাবনা মাথায় আসলে সেটা দ্রুততার সাথে টুকে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জার্নাল, ড্রইং প্যাড, ওয়াকম ট্যাবলেট, মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট প্রভৃতি সাথে করে নিয়ে যান!
এই অভ্যাসটি নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরও ছিলো। যখনই তাদের মাথায় কোনো অসাধারণ আইডিয়া আসতো তা টুকে ফেলতেন। প্রখ্যাত ডিজাইনার ও ইলাস্ট্রেটর ক্রেইগ ওয়ার্ড বলেছেন, “যখনই কোনো মাধ্যম থেকে ভিজ্যুয়াল ওয়ার্ড বা ফ্রেজ আপনার মনে ধরবে সেটাকে তখনই নোটবুকে টুকে ফেলুন বা স্কেচ করুন, আর মাধ্যমটি হতে পারে কোনো গান বা আর্টিকেলের কোনো লাইন!” আর এভাবেই এই ভালো অভ্যাসটি আপনাকে পরবর্তীতে অনেক সাফল্যমণ্ডিত কাজের পেছনের গল্প হয়ে থাকবে।
যে মুহূর্ত থেকে মনে হবে একঘেয়েমির কারণে আপনি সকল ধরণের সৃজনশীল কাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তখনই নিজেকে এক নিমিষেই কৈশোরে নিয়ে চলুন। নিয়ে চলুন কৈশোরের সেই বিস্তৃত খোলা প্রান্তরে, যেখানে খেলাধুলা করার সময় ডিজাইনের কোনো কঠিন প্যাটার্ন বা কালার কম্বিনেশন নিয়ে চিন্তা করতে হয় নি! এটি আপনার মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। আর একারণেই গুগল কিংবা ফেসবুকের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অফিসে আলাদা প্লে গ্রাউন্ডের ব্যবস্থা করেছে। আর
মেডিটেশনের মাধ্যমে মনকে মুক্তি দেয়া সম্ভব। এটি সৃজনশীলতা বাড়াতেও সাহায্য করে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেডিটেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে কেন্দ্রীভূত করে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের জন্য প্রস্তুত করা যায়। মানসিক জটিলতাকে দূর করে নমনীয় ভাব আনতেও এটা বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখে। মাত্র ১০ মিনিটের মেডিটেশন এক ঘণ্টা পর্যন্ত কাজে দেয়। তাই এখনই নিজেকে মেডিটেশনের জন্য প্রস্তুত করে ফেলুন! সময় মাত্র ১০ মিনিট!
সবসময়ই নিজের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিন। তবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সেটা আপনার ক্যারিয়ারের জন্য কতটা ভালো কিংবা মন্দ সেটার পরিসংখ্যান করে নিন। এক্ষেত্রে কে কি বললো, কি সমালোচনা করলো সেটার ধার ধারবেন না। অতীতে করা যেকোনো সফল প্রজেক্টের ক্ষেত্রে যে ধাপগুলো অনুসরণ করেছিলেন সেগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করুন। একসময় দেখবেন, ভালো ফলাফল আসবেই
যেকোনো মুহূর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যেতেই পারে। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখুন। কারণ ভালো খারাপের মিশেলেই আমরা সবাই মানুষ! তাই জীবনে কোনো খারাপ সময় গেলে সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নিন। সময়ের পরিবর্তনে সবকিছুই পরিবর্তিত হয়। খারাপ সময় ভালো সময়ে রুপান্তরিত হতে খুব বেশি সময় নাও নিতে পারে! তাই আজই সকল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কাঙ্ক্ষিত করে ফেলার চেষ্টা করুন।
যে স্টুডিওতে বসে কাজ করছেন তার আশপাশ বদলে ফেলুন। হয়তো এখানে নতুন কিছু যুক্ত করতে পারেন। কিংবা যা আছে সেগুলোই একটু অদলবদল করে ফেলুন। চারপাশ বদলে যাওয়ার সাথে আপনার মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন আসতে পারে! শুধু নিজের আবাসস্থলে বসে কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেলে যেকোনো ট্রেন কিংবা খোলা মাঠে বসেও ডিজাইন বা সৃজনশীল কাজ করতে পারেন। পরে সেটা বাসায় গিয়ে মোডিফাই করে নিতে পারবেন।
আবারো ধরুন(কারণ আমি এর আগে আরও একবার ধরতে বলেছি!), আপনি একজন ডিজাইনার। ডিজাইন দিয়ে ক্লায়েন্টকে খুশি করতে পারছেন না, অপরদিকে চাপও প্রচুর। অন্যদিকে আপনার সৃজনশীল কাজ তৈরি হওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেছে। এরকম ঝামেলাপূর্ণ পরিস্থিতিতে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দিন আর তা কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্যই! নিজের মনের সাথে তাল মিলিয়ে এবং কোনো রকম সমালোচনার তোয়াক্কা না করে আপনার মন যা বলছে তা-ই করে ফেলুন। সেটা হতে পারে কোনো কালারিং বই কালার করা, অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে গল্প লেখা! অনেকে হয়তো ভাবছেন, সময় না থাকলে এগুলো করার সময় কখন? আসলে ভালো কিছু পেতে কিছু ছাড় দিতে হয়। একসময় নিজেই খেয়াল করে দেখবেন, এসব অহেতুক কাজ আপনার সময় নষ্ট করে নি, বরং আপনার সৃজনশীল কাজের জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট হিসেবেই কাজ করছে।
হার্টের ব্লকের মতো সৃজনশীলতা হলে যেমন তা শরীরের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে, তেমন সৃজনশীলতায় ব্লক আসলেও তা আপনার ক্যারিয়ারে সুদূরপ্রসারী খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই আজকেই উপরের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে এসব ব্লক খুলে দিন!
তথ্যসূত্রঃ
https://99designs.com
https://www.creativebloq.com
মন্তব্য করুন
ফেইসবুক দিয়ে মন্তব্য